কিশোরীর শখের শাড়ি

কিশোরীদের কাছে শাড়ি মানেই আনন্দ ও উৎসবের পোশাক। মডেল: মধুরিমা ও ফিজা, শাড়ি: দেশাল, সাজ: মিউনিস ব্রাইডাল, ছবি: কবির হোসেন
মা গেছেন অফিসে। কী কারণে যেন সেদিন স্কুল বন্ধ মেয়েটির। আলনা থেকে মায়ের ঘরে পরা শাড়িটা টেনে নিয়ে অনভ্যস্ত হাতে কুচি দিতে শুরু করল, কোনো রকমে গায়ে পেঁচিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছেন আপা?’ যেমন মাকে করতে দেখে…এই তো কিশোরীর প্রথম প্রথম শাড়ি পরা! নিজেকে বড় বড় ভাবতে শেখা।

রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতনের কথাই বলুন কিংবা ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী—ঘরকন্যার কাজ থেকে দস্যিপনা…কিশোরী যাই করুক না কেন, পরনে তার ব্লাউজহীন একপেঁচে শাড়ি। বিভূতিভূষণের দুর্গাও সত্যজিতের পরিচালনায় ওই একপেঁচে শাড়ি পরেই কাশবনের ভেতর দিয়ে ছুটেছে রেললাইনের দিকে পথের পাঁচালিতে। দৌড় দৌড় দৌড়, দিদির সঙ্গে দৌড়ে পারে না অপু। এই শাড়ি পরেই ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা, এই শাড়ি পরেই জ্বরের সঙ্গে পাঞ্জা।

দিন বদলেছে। শহর তো দূরে থাক বাংলাদেশের গ্রামের কিশোরীরাও এখন শাড়ি পরে উৎসবে, অনুষ্ঠানে, শখে। বোনের গায়েহলুদ কিংবা স্কুলের বৈশাখী মেলা—এই তো কিশোরীর শাড়ি পরার বাহানা! আর শেখা? এখন কি আর শাড়ি পরা শিখতে হয়? বিউটি পারলার আছে না? কিন্তু তারপরও দেখা যায় কেউ কেউ নিপুণ হাতে পাট পাট শাড়ি পরতে পারে, পরাতে পারে। নাইবা পরল রোজ রোজ তবু এই পোশাক যে আমাদের নিজেদের পোশাক, তাই শিখতে অসুবিধা?

দাওয়াতে অনেক কিশোরী বেছে নেয় শাড়িই। শাড়ি: ড্রেসিডেলদাওয়াতে অনেক কিশোরী বেছে নেয় শাড়িই। শাড়ি: ড্রেসিডেলজাপানি একটি মেয়ে প্রথম আলোতে এসেছিল ইন্টার্ন হয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে চায়। ছিল তিন মাস। প্যান্ট টপ, সালোয়ার-কামিজ নানা পোশাকেই দেখেছি তাকে। একদিন এক উৎসবে প্রথম আলোর অন্য মেয়েদের সঙ্গে শাড়ি পরে এল সে। ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছিল। ওর কুচি ধরে হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল বাঙালি কিশোরী প্রথম শাড়ি পরা শিখে হাঁটছে! জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি শখ করে আমাদের ঐতিহ্যের পোশাক পরলে, দেশে উৎসবে কিমোনো (এতিহ্যবাহী জাপানি পোশাক) পরো?

-কিমোনো? না না না। ওটা অনেক জটিল। পরতে পারি না। পরলে হাঁটতে পারি না। জাপানে তরুণীরা কিমোনো পরতে ভয় পায়।

না, আমাদের শাড়িকে কিশোরীরা এখনো ভয় পায় না। নিত্যকার পোশাক না হলেও শাড়ি এখনো কিশোরীদের কাছে আনন্দের উৎসবের পোশাক। নিজেকে একটু বড় ভাবার সুযোগ। বিশেষ করে পয়লা বৈশাখে কিশোরীদের শাড়ি পরার ধুম পড়ে। পয়লা ফাল্গুন বা বসন্তের কোনো আয়োজনেও ওরা শাড়ি পরে। হয়তো মা-বোন-ভাবি পরিয়ে দেয় আর বিউটি পারলার তো আছেই। এই সময়টাতে ডিজাইনাররাও কিশোরীদের কথা ভেবে তৈরি করেন আলাদা শাড়ি। বান্ধবীরা দল বেঁধে একই রঙের শাড়ি পরেন কিংবা মায়ের সঙ্গে মেয়ের হয় যুগলবন্দী। তারপর ঠাস করে সেলফি একটা। রঙে রঙে মিল।

শাড়ি কিন্তু ভারি রোমান্টিক পোশাক বাঙালির জীবনে। কবি-সাহিত্যিকের বর্ণনায় তা আরও মিষ্টি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগের এক ছড়া থেকে চারটি লাইন বলছি-

শীতের বেলায় দুই পহরে

দূরে কাদের ছাদের পরে

ছোট্ট মেয়ে রোদ্‌দুরে দেয়

বেগনি রঙের শাড়ি…

একজনের অগোছালো শাড়িকে গুছিয়ে দেয় আরেক কিশোরী। শাড়ি: রঙ বাংলাদেশ ও বিবি প্রডাকশনসএকজনের অগোছালো শাড়িকে গুছিয়ে দেয় আরেক কিশোরী। শাড়ি: রঙ বাংলাদেশ ও বিবি প্রডাকশনস

কিশোরী মেয়েদের সবার শাড়ি তো আর বেগুনি রঙের হবে না, তবে যখন প্রথম প্রথম শাড়ি পরে মেয়েটি সবার সামনে আসবে দেখবেন ওর মধ্যে লজ্জা, ভালো লাগার অদ্ভুত এক মিশেল। আর মুখ ফুটে কেউ যদি বলেই ফেলি ‘মারে তোকে যে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে’—দেখবেন লজ্জায় লাল নয় বেগুনি হয়ে যাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটির মুখ! আর তৎক্ষণাৎ আপনার মনে হবে শাড়িটাড়ি পরে মেয়েটা চোখের সামনে বড় হয়ে গেল।

সেই কবে মা অফিসে গেলে আলনা থেকে টেনে শাড়ি পরে ‘আপা আপা’ সেজেছিল মেয়েটি। ঘরের কাপড় রাখার আলনার দিন কবেই গেছে ফুরিয়ে, দিন যায়, দিন বদলায়—কিন্তু এ যুগের কিশোরীর শাড়ি পরার শখ কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি।

এই তো নিয়ম। ছোটবেলায় বড় হতে মন চায়, আর বড়বেলায় ছোট!